অটোক্যাড কী

ইঞ্জিনিয়ারিং এবং আর্কিটেক্ট পেশাজীবীদের জন্য অটোক্যাড একটা আবশ্যকীয় সফটওয়্যার যা শিখতেই হয়। তবে ইঞ্জিনিয়ার এবং আর্কিটেক্ট ছাড়াও অন্যান্য পেশাজীবীর মানুষেরাও অটোক্যাড শেখেন কারণ 2D ও 3D ডিজাইনের ক্ষেত্রে অটোক্যাড একটা দারুণ সফটওয়্যার। কাজেই, যারাই ডিজাইনিং বা ড্রয়িং পেশার সাথে যুক্ত, তাদের জন্য অটোক্যাড একটা আশির্বাদ।

অটোক্যাড ভালোভাবে জানা থাকলে ক্যারিয়ারের জন্য একটা বুস্টার হিসেবে কাজ করে। এছাড়া শুধুমাত্র এই সফটওয়্যারটা শিখে অনেকেই ঘরে বসেই ফ্রিল্যান্সিং করতে পারেন। এই আর্টিকেলে আমরা জানবো অটোক্যাড কী, এর প্রয়োজনীয়তা কী, কীভাবে শেখা যাবে এবং অটোক্যাড শিখে আয় করার পদ্ধতি কী কী।

অটোক্যাড কী

অটোক্যাড মূলত একটি সফটওয়্যার যা ডিজাইন ও ড্রয়িং এ ব্যবহৃত হয়। এই সফটওয়্যারটির প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ C+ এবং এটা খুবই ইউজার ফ্রেন্ডলি সফটওয়্যার। এটি আমেরিকান কোম্পানি অটোডেস্কের তৈরি বহুল ব্যবহৃত ও জনপ্রিয় একটি সফটওয়্যার।

অটোক্যাড দিয়ে আপনি খুব সহজেই তৈরি করে ফেলতে পারবেন 2D ও 3D ডিজাইন। ফলে ডিজাইনার, ইঞ্জিনিয়ার ও আর্কেটেক্টদের কাছে অটোক্যাড খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ডিজাইন তৈরি হয় অটোক্যাড দিয়ে। প্রথমে অটোক্যাডে ড্রয়িং তৈরি করে সেই অনুযায়ী ইঞ্জিয়াররা কাজ শুরু করেন।

অটোক্যাডের একটা বড় সুবিধা হচ্ছে ডিজাইনের যে কোনো ভুলত্রুটি অটোক্যাড দিয়েই যাচাই করা সম্ভব। ফলে এটি যেমন সময় বাঁচায় তেমনি কাজ দ্রুত গতিতে আগায় এবং অর্থ সাশ্রয় হয়।

ইঞ্জিনিয়ার, আর্কিটেক্ট বা ডিজাইনার হিসেবে ক্যারিয়ার বেছে নিলে তাই অটোক্যাডের বিকল্প নেই। আপনার কাজের ক্ষেত্রে প্রোফেশনালিজম বজায় রাখতে এবং ক্যারিয়ারে সফল হতে হলে অটোক্যাডের খুঁটিনাটি শেখা প্রয়োজন।

অটোক্যাডের প্রয়োজনীয়তা:

স্থাপত্যশিল্পের সর্বক্ষেত্রে অটোক্যাডের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রেও রয়েছে এর বিভিন্ন ব্যবহার। যেমন-
১। আর্কিটেকচারঃ স্থপতিদের জন্য অটোক্যাডের কোনো বিকল্প নেই। কারণ যত ধরনের দালান, ভাস্কর্য, বিল্ডিং, ব্রিজ সহ যা কিছুই আপনি ডিজাইন করেন না কেন, অটোক্যাডের ডিজাইন হয় সবচেয়ে নির্ভুল। মাপজোখের ক্ষেত্রে যেমন অটোক্যাড নির্ভুল তেমনি এতে করে সময় বাঁচে। তাছাড়া বিস্তারিত ডিজাইন তৈরি করতেও এর জুড়ি নেই। এছাড়া অটোক্যাডের সাহায্যে যে কোনো স্থাপনার 3D ডিজাইন করা সম্ভব। ফলে আপনার ক্লায়েন্টকে আপনি একদম বাস্তবসম্মত ডিজাইনের ছবি দেখাতে পারবেন।
২। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংঃ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের মূল কাজ যে কোনো স্থাপনা, বিল্ডিং, সেতু, ভবন, কালভার্ট, বাঁধ ইত্যাদির অবকাঠামো তৈরি। তাই এইসব অবকাঠামো ডিজাইনের ক্ষেত্রে অটোক্যাডের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অটোক্যাডের মাধ্যমে আপনি নির্ভুলভাবে সূক্ষ্ম পরিমাপের কাজ করতে পারেন। এছাড়া ডিটেইল ড্রাফটিং করা যায় বলে অন্য যে কোনো ইঞ্জিনিয়ারের পক্ষে ডিজাইন বোঝা সহজ হয়। এতে করে মাঠ পর্যায়ে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় বেঁচে যায়। তাছাড়া অটোক্যাডের তৈরি ডিজাইন যে কোনো সময় পরিবর্তন ও পরিমার্জন করা সহজ।

৩। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংঃ মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য বিভিন্ন যন্ত্র ও যন্ত্রের পার্টসের ডিজাইন করতে অটোক্যাডের প্রয়োজন হয়। এই সফটওয়্যারে জুম নামের একটা কমান্ড রয়েছে যা ব্যবহার করে যে কোনো যন্ত্রের পার্টসকে অনেক বড় স্কেলে আঁকানো যায়। ফলে ডিজাইনের কাজ নির্ভুল হয়।
৪। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংঃ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন ধরনের পার্টস যেমন ইলেকট্রিক লাইন, সুইচ বোর্ড, ফ্যান, এসি, ইত্যাদির অবস্থান নির্ণয় করে ড্রয়িং করার কাজে অটোক্যাড ব্যবহার করা হয়। সার্কিট ডিজাইন করার জন্য অনেক ক্ষুদ্র স্কেলে অটোক্যাড ব্যবহার করা যায়।
৫। অন্যান্য ব্যবহারঃ অটোক্যাডের সাহায্যে ইঞ্জিনিয়ারিং ও স্থাপত্য শিল্প ছাড়া অন্যান্য ডিজাইন করাও সম্ভব। ইদানীং এনিমেশন সিনেমা, কার্টুন, পোশাকের ডিজাইন, লোগো, মার্কেটিং ক্রিয়েটিভ সহ সব ধরনের ডিজাইনেই অটোক্যাড ব্যবহার করা হয়। এছাড়া ঘরের সৌন্দর্য বর্ধনে বিভিন্ন শোপিস, কাঠের নকশা, প্লাস্টিক বা কাঁচের জিনিসের উপর নকশা, এমব্রয়ডারি সহ যে কোনো কিছুর ডিজাইনই অটোক্যাড দিয়ে করা সম্ভব। অল্প সময়ে নির্ভুল ভাবে অটোক্যাড দিয়ে ডিজাইন করা যায় বলে পণ্য উৎপাদনশীল কারখানাগুলো অটোক্যাডের উপর নির্ভরশীল।

অটোক্যাড শেখার নিয়ম:

সরকারি এবং বেসরকারি- দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানেই আপনি অটোক্যাড শিখতে পারেন। আপনি যদি ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হন তাহলে আপনার কোর্স কারিকুলামেই অটোক্যাডের অনেকটা শেখা হয়ে যাবে। এছাড়া যদি কেউ নিজে নিজে শিখতে চায় তবে অনলাইনে অনেক ধরনের ফ্রি কোর্স রয়েছে যা থেকে অটোক্যাড শেখা সম্ভব।
কেউ যদি টানা তিনমাস নিয়মিত প্র্যাকটিস করে, তবে সে অটোক্যাডে খুব ভালো দক্ষতা অর্জন করতে পারবে।

সরকারি বিভিন্ন পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটগুলোতে ৬ মাস মেয়াদী অটোক্যাড কোর্স শেখানো হয়। এই কোর্সগুলো সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পরিচালনা করা হয়। অভিজ্ঞ শিক্ষকদের দিয়ে এই কোর্স পরিচালনা করা হয়। আবার কোর্স শেষ হলে সরকারি সার্টিফিকেট ও দেয়া হয়। সরকারিভাবে সুযোগ না পেলে প্রাইভেটভাবেও অনেকে অটোক্যাড শিখতে পারে। যে কোনো কম্পিউটার ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে যে কেউ এই কোর্স বেসরকারিভাবে শিখতে পারে। এছাড়া শেখার পর কারিগরি বোর্ডে পরীক্ষা দিলে সরকারি সার্টিফিকেট ও পাওয়া যায়।

বর্তমানে অটোক্যাড শেখার সবচেয়ে সেরা সুযোগ রয়েছে অনলাইনে। অনলাইনে Udemy, Coursera, Hubspot, edX সহ অনেক ধরনের প্ল্যাটফর্ম রয়েছে যেখানে অটোক্যাড শেখা যেতে পারে। ঘরে বসে শেখার সুবিধার কারণে ছাত্রদের পাশাপাশি চাকরিজীবীরাও এই কোর্সে এনরোল করতে পারেন। তবে এইসব প্ল্যাটফর্ম গুলতে সাধারণত টাকা দিয়ে কোর্স কিনতে হয়। আর তাই, বিনামূল্যে অনলাইনে শেখার সবচেয়ে সুন্দর সুযোগ দেয় ইউটিউব। ইউটিউবে প্রচুর সংখ্যক টিউটোরিয়াল রয়েছে। নিজের সুবিধাজনক সময়ে এইসব টিউটোরিয়াল দেখে নিজে নিজে পর্যাপ্ত প্র্যাকটিস করলে সহজেই অটোক্যাড শেখা হয়ে যাবে। যে কোনো কোর্সই শেখার চেয়ে প্র্যাকটিস করা গুরুত্বপূর্ণ। আপনার দক্ষতা তখনি বাড়বে যখন আপনি নিয়মিত প্র্যাকটিস করবেন। তাই, শুহদু শিখে রাখলে চলবে না বরং নিয়মিত প্র্যাকটিস করতে হবে যেন মার্কেটে কাজ করার সময় আপনি পুর্ণ দক্ষতা নিয়ে কাজ করতে পারেন।

অটোক্যাড শিখে আয় করা যায়?

আপনি যদি অটোক্যাড ডিজাইনে দক্ষ হন তাহলে বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে আপনার চাকরির সুযোগ রয়েছে। একতা সময় অটোক্যাড শুধু আর্কিটেকচার ফার্মের জন্যই সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু এখন
সেটা অন্যান্য ডিজাইনিং জগতেও ছড়িয়ে পড়েছে। ম্যানুফ্যাকচারিং থেকে শুরু করে এনিমেশন পর্যন্ত অটোক্যাডের কাজ রয়েছে।

• অটোক্যাড জানা থাকলে আপনি একজন ড্রাফটসম্যান হিসেবে কাজ করতে পারবেন অর্থাৎ যে কোনো বৈদ্যুতিক সিস্টেমের ডিজাইন আপনি করতে পারবেন।
• অটোক্যাড জানা থাকলে আপনি আর্কিটেকচার ফার্ম, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম, মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে চাকরি করতে পারবেন।
• আপনি CAD অপারেটর হিসেবে বিভিন্ন কনসাল্টেন্সি ফার্মে কাজ করতে পারবেন।
• প্রোডাক্ট ডিজাইনারের চাহিদা এখন মার্কেটে সবচেয়ে বেশি, অটোক্যাড শেখা থাকলে আপনি যে কোনো পণ্যের থ্রিডি ডিজাইন করতে পারবেন।
• পোশাক ডিজাইনের ক্ষেত্রেও অটোক্যাড খুব কাজের। আপনি চাইলে গার্মেন্টস শিল্পে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে পারেন পোশাক ডিজাইনার হিসেবে।
• এছাড়া আপনি যদি ঘরে বসে কাজ করতে চান, তাহলে বিভিন্ন মার্কেটপ্লেসে অটোক্যাড ডিজাইনার হিসেবে ফ্রিল্যান্সিং করতে পারবেন। তথ্য-প্রচুক্তির এই যুগে বাংলাদেশে বসেই আপনি ইন্টারন্যাশনাল যে কোনো ফোরামে নিজের ক্যারিয়ার গড়ে নিতে পারেন।

শেষ কথা

ড্রয়িং ও ডিজাইনের দুনিয়ায় অটোক্যাডের চাহিদা দিন কে দিন বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে স্থাপত্য শিল্পে নিখুঁত 2D ও 3D মডেলিং এর ডিজাইন এবং যন্ত্রপাতি সিমুলেশনের জন্য অটোক্যাড অপারেটর প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানেই প্রয়োজন। তাই আপনি যদি সঠিকভাবে শিখে নিজের দক্ষতা বাড়াতে পারেন, অটোক্যাড অপারেটর হিসেবে আপনার ক্যারিয়ারে রয়েছে অপার সম্ভাবনা।